রহস্যময় ইউরেনিয়াম এবং স্পষ্ট না হওয়া হামলার প্রভাব
সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা নতুন মোড় নেয়, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একযোগে ইরানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় বিমান হামলা চালায়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই অভিযানকে “সামরিক সফলতা” হিসেবে আখ্যায়িত করলেও, প্রশ্ন থেকেই যায়—ইরানের ইউরেনিয়াম গেল কোথায়? এবং কেন এখনো তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানোর প্রমাণ মেলেনি?
যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলা: কাদের টার্গেট করা হয়েছিল?
২০২৫ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি রাতে, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের নাতাঞ্জ, ফর্দো ও ইসফাহান পারমাণবিক স্থাপনায় ভয়াবহ হামলা চালায়। এই তিনটি স্থাপনাই বহুদিন ধরে ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।
ইসফাহান: একটি পুরাতন পারমাণবিক গবেষণাকেন্দ্র, যেখানে ইউরেনিয়াম রূপান্তরের কাজ হতো।
নাতাঞ্জ: ইরানের সবচেয়ে বড় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র।
ফর্দো: একটি ভূগর্ভস্থ সাইট যা প্রায় ২০০ ফুট নিচে গঠিত, বিশেষভাবে রাডার ও স্যাটেলাইট থেকে লুকিয়ে রাখা যায়।
ট্রাম্পের দাবি ছিল, এই তিনটি কেন্দ্র সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা হয়েছে। কিন্তু, বাস্তবতা কি সত্যিই তাই?
হামলার পর নেই তেজস্ক্রিয়তা—কেন?
বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, এত বড় পরমাণু স্থাপনায় হামলার পরও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলো (বিশেষত IAEA) নিশ্চিত করেছে, কোনো তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েনি। এই তথ্য রীতিমতো প্রশ্ন তোলে:
- হামলায় কি সত্যিই ইউরেনিয়াম ধ্বংস হয়েছে?
- নাকি আগেই সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল?
একে কি বলা যায় “পূর্বপ্রস্তুতি”?
ইরানের বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা এবং মিডিয়া যেমন IRNA এবং Al Jazeera দাবি করছে, হামলার আগে থেকেই সাইটগুলো খালি করে ফেলা হয়েছিল। অনেক বিশ্লেষকের মতে, ইরান হয়তো আগেই সম্ভাব্য হামলার পূর্বাভাস পেয়েছিল এবং তাদের মূল্যবান ইউরেনিয়াম সরিয়ে ফেলেছিল নিরাপদ স্থানে।
হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্র ও কৌশল
যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনী এই হামলায় বাংকারবিধ্বংসী বোমা (GBU-57) ব্যবহার করেছে।
এই বোমা ৬০ মিটার গভীর মাটিতে ঢুকে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে এবং প্রতি বোমার ওজন প্রায় ১৩,৬০০ কেজি।
ফর্দোতে নিক্ষিপ্ত হয় কমপক্ষে ১৪টি বোমা, যা ইঙ্গিত দেয় হামলার মাত্রা কতটা গুরুতর ছিল। তবুও, চূড়ান্ত ক্ষয়ক্ষতি বিষয়ে নিরপেক্ষ কোনো সূত্র থেকে এখনো পূর্ণাঙ্গ তথ্য মেলেনি।
হামলার রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও আন্তর্জাতিক উদ্বেগ
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি হামলাকে “সরাসরি আগ্রাসন” আখ্যা দিয়ে বলেন, “এই হামলার জন্য সম্পূর্ণ দায় ওয়াশিংটনের যুদ্ধবাজ প্রশাসনের।” তুরস্ক, কুয়েত এবং বিভিন্ন উপসাগরীয় দেশ থেকেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
IAEA প্রধান রাফায়েল গ্রোসি স্পষ্ট করেছেন, তেজস্ক্রিয়তা না ছড়ানো ইঙ্গিত দেয় যে মূল ইউরেনিয়াম সম্ভবত আগেই স্থানান্তরিত হয়েছিল।
তাহলে ইউরেনিয়াম কোথায় গেল?
বিশ্লেষকদের মতে, ইরানের পরমাণু কর্মসূচির মূল সম্পদ হল সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম। যদি তা এখনো ইরানের হাতে থাকে, তাহলে পুরো কর্মসূচি কার্যকরভাবে বহাল রয়েছে। বিশ্লেষক ট্রিটা পার্সি বলেছেন, “সম্ভবত ইরান আগেই এসব উপাদান সরিয়ে ফেলেছিল, কিন্তু সেগুলো এখন কোথায় রয়েছে তা স্পষ্ট নয়।”
এক্ষেত্রে দুটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা রয়েছে:
- ইরান আগাম সতর্কতা পেয়েছিল এবং আগে থেকেই সরিয়ে নিয়েছিল ইউরেনিয়াম।
- যুক্তরাষ্ট্রের দাবি অতিরঞ্জিত, হামলার প্রভাব বাস্তবের তুলনায় অনেক কম।
ভবিষ্যৎ কী হতে পারে: ইরানের পারমাণু কর্মসূচির চ্যালেঞ্জ
এই হামলা ইরানের পারমাণবিক শক্তি ব্যবস্থার উপর একটা চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে ঠিকই, কিন্তু তা আদতে কতটা দীর্ঘমেয়াদে প্রভাব ফেলবে তা এখনো পরিষ্কার নয়।
বিশ্লেষকদের মতে:
- হামলায় স্থাপনাগুলোর কাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে, তবে প্রযুক্তি বা মূল উপাদান হয়তো ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।
- ইরান তার বেসামরিক পারমাণবিক প্রকল্প চালিয়ে নিতে আগ্রহী এবং এমন কোনো প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি যে তারা যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করছে।
অতীত অভিজ্ঞতা: এটি প্রথমবার নয়
ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এটি আগেও বিভিন্ন প্রতিকূলতায় পড়েছে। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লব, ১৯৮০–৮৮ সালের ইরান–ইরাক যুদ্ধ এবং বিশেষভাবে স্টাক্সনেট ভাইরাস এর মাধ্যমে সাইবার হামলা ইরানের কর্মসূচিকে বহুবার ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
এই অভিজ্ঞতা থেকেই ইরান সম্ভবত এবার আরও আগাম প্রস্তুতি রেখেছিল।
উপসংহার: হামলা সত্যি, ধ্বংস নয়
যদিও যুক্তরাষ্ট্র এই হামলাকে ‘সফল’ বলছে এবং ইসরায়েল এর পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছে, বাস্তবতা অনেকটাই ভিন্ন। কোনো ইউরেনিয়াম ধ্বংস হয়নি, তেজস্ক্রিয়তা ছড়ায়নি এবং পরমাণু কর্মসূচির ভবিষ্যৎ এখনো নির্ধারিত নয়।