বাজেট ২০২৫–২৬
WhatsApp
WhatsApp Channel
Join Now
Telegram Telegram Channel Join Now

বাংলাদেশের ঋণ বৃদ্ধির ইতিহাস – স্বৈরশাসন থেকে কর্তৃত্ববাদ পর্যন্ত

বাংলাদেশে ঋণের বোঝা কখনই কমেনি—বরং ক্ষমতার গঠনের সঙ্গে সঙ্গে তা নিয়মিত বেড়েছে। ১৯৮২ সালে জেনারেল এরশাদের স্বৈরশাসনে ঋণ ছিল ৭.৫ বিলিয়ন ডলার। ১৯৯০ সালে তা ১৪.৫ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল।

শেখ হাসিনার ক্ষমতাকালে ঋণ আরও বেড়ে ৩২২% হয়েছে। ২০০৯ সালে যা ছিল ২৩ বিলিয়ন ডলার, ২০২৪ সালে তা ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।

এই ধরনের ঋণ বৃদ্ধি মূলত রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে ঘটেছে। যা ক্ষমতা ধরে রাখার একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এই চক্র ভাঙতে হবে—নতুবা দেশ ঋণের ফাঁদে আটকে যাবে।


অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জিং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি

পতিত সরকার এমন এক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি রেখে গেছে যা সমাধান করা সহজ নয়। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, রাজস্ব খাতে দুর্নীতি, বাজেট বাস্তবায়নে ধীরগতি, ব্যাংক খাতে তারল্যসংকট, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস—সবই বিদ্যমান।

তাই ২০২৫–২৬ অর্থবছরের বাজেটে স্বল্পমেয়াদি সমাধান ও মধ্যমেয়াদি সংস্কার দুটোই প্রয়োজন। এর মধ্যে ঋণের বোঝা কমানো হবে অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ।


ঋণের অবস্থা কতটা গুরুতর?

২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ঋণ-জিডিপি অনুপাত ছিল ৩৭.৮%, অভ্যন্তরীণ ঋণ-রাজস্ব অনুপাত ২৭৬%, আর বৈদেশিক ঋণ-রপ্তানি অনুপাত ১৪৬.২%। এসব পরিসংখ্যান ঝুঁকির ইঙ্গিত দেয়।

মোট সরকারি ঋণ এখন ১৮.৩২ লাখ কোটি টাকা। গত ১৫ বছরে গড়ে বার্ষিক ১.০৪ লাখ কোটি টাকা করে বেড়েছে। এখন পরিস্থিতি সংকটের মধ্যে না থাকলেও ঋণ কাঠামো বড় ঝুঁকি নির্দেশ করছে।


ঋণ পরিশোধের খরচ তীব্রভাবে বাড়ছে

ঋণ পরিশোধের বোঝা দ্রুত বাড়ছে। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ২৬% বেড়ে ৩.৩৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এর মধ্যে সুদ পরিশোধ ৪৪% বেড়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ৯ মাসে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ ২৪.৯% বেড়েছে।

অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ ৯ লাখ ৪২ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। যা ২০২১ সালে ৭ লাখ ২২ হাজার ৫৯১ কোটি ছিল। সুদ পরিশোধ রাজস্ব বাজেটের ৫১.৫% দখল করে রেখেছে। কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া এ পরিস্থিতি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে বাধাগ্রস্ত করবে।


রাজস্ব সংগ্রহ পিছিয়ে, প্রকল্প বাস্তবায়ন ধীরগতির

২০২৪–২৫ অর্থবছরের জুলাই–ডিসেম্বরে রাজস্ব বৃদ্ধি মাত্র ৪.৪%। বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আরও ৫৫.৫% বৃদ্ধি প্রয়োজন। কিন্তু তা অর্জন করা প্রায় অসম্ভব মনে হচ্ছে।

চলতি অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়নের হার ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। এই ধীরগতি কর ভিত্তি সম্প্রসারণ, জালিয়াতি নিয়ন্ত্রণ এবং কর্মক্ষমতা বাড়ানোর জরুরি প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরছে।


ঋণে ঋণ শোধ: কি থেকে কি হচ্ছে?

বাজেটে কি ঋণের বোঝা কমানোর কৌশল থাকবে? এটাই এখন সবার প্রধান প্রশ্ন। এখানে সম্ভাব্য ৫টি কৌশল হতে পারে:


১. অবৈধ ঋণ পর্যালোচনা ও বাতিলের কৌশল

স্বৈরতান্ত্রিক ও কর্তৃত্ববাদী শাসনামলে নেওয়া অবৈধ ঋণগুলো পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজন। জাতিসংঘের সহায়তায় একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করে এগুলো বাতিলের পথ খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।

উদাহরণ হিসেবে, ২০০৩ সালে ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের আমলের ১২৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ বাতিল করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। একই কৌশল বাংলাদেশেও কাজে লাগানো যেতে পারে।


২. ঋণ–উন্নয়ন–বিনিময় কৌশল

বৈদেশিক ঋণকে স্থানীয় বিনিয়োগে রূপান্তর করার নতুন পদ্ধতি হতে পারে একটি কার্যকর সমাধান। এতে জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলা, শিক্ষা খাত শক্তিশালীকরণ এবং স্বাস্থ্য অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করা যেতে পারে।

এই পদ্ধতি বৈদেশিক ঋণ কমাতে সাহায্য করবে এবং সম্পদ সরাসরি জনকল্যাণে ব্যবহৃত হবে।


৩. ব্যয় দক্ষতা বৃদ্ধি ও অগ্রাধিকার নির্ধারণ

অভ্যন্তরীণ সুদ পরিশোধ ও পরিচালন ব্যয় কমাতে ঋণ ব্যবস্থাপনা ও ভর্তুকি যুক্তিসঙ্গতকরণ জরুরি।

সরকারি ব্যয় পর্যালোচনা কাঠামো গঠন, কঠোর ব্যয়-লাভ বিশ্লেষণ নির্দেশিকা এবং কর্মক্ষমতা ভিত্তিক বাজেটিং পদ্ধতি প্রবর্তন করা দরকার। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোকে একই কর্তৃপক্ষের অধীনে এনে ‘পূর্ণ জীবনচক্রভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল’ গড়ে তোলা দরকার।


৪. ঋণ ব্যবস্থাপনা কৌশল

সরকারি ঋণ কাঠামোর গুণগত উন্নয়ন এখন অত্যাবশ্যিক। সুদ পরিশোধ বৃদ্ধির সঙ্গে স্বল্পমেয়াদি ঋণের ঝুঁকি বেড়েছে।

স্বল্পমেয়াদি ঋণের উপর নির্ভরতা কমানো জরুরি। রাজস্ব ও মুদ্রানীতির মধ্যে সমন্বয় বাড়িয়ে সরকারি ঋণ সংগ্রহকে অনুকূলিত করা দরকার।

এ ক্ষেত্রে ‘মধ্যমেয়াদি ঋণ ব্যবস্থাপনা কৌশল (MTDS)’ প্রণয়ন করা যেতে পারে। এতে ঋণ স্থিতিশীলতা বাড়বে এবং অভ্যন্তরীণ ঋণবাজারও শক্তিশালী হবে।


৫. স্বল্পমেয়াদি ঋণের ওপর নির্ভরতা কমানো

স্বল্পমেয়াদি ঋণের ওপর নির্ভরতা কমালে সরকারি দায় কমবে। এর ফলে ব্যক্তিগত খাতে ঋণ প্রবাহ বজায় রাখা সম্ভব হবে।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকারি খাতে ঋণ নেওয়া বন্ধ করলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি আসবে।


ঋণের বোঝা কমাতে কি পথ খুঁজে পাবে বাজেট ২০২৫–২৬?

ঋণের বোঝা কমানো এখন একটি জরুরি বিষয়। একটি ভারসাম্যপূর্ণ বাজেটে স্বল্পমেয়াদি ঋণের ওপর নির্ভরতা কমানো, রাজস্ব বৃদ্ধি, প্রতিষ্ঠানগত সংস্কার, এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পথ তৈরি করা দরকার।

আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের সহায়তা প্যাকেজ স্বল্পমেয়াদি তারল্য দূর করতে সাহায্য করবে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা পেতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ছাড়া গতি হবে না।


‘ঋণ নিয়ে ঋণ শোধ’ থেকে মুক্তি সম্ভব কি?

হ্যাঁ, সম্ভব। কিন্তু সেটি হবে শুধুমাত্র তখনই, যখন বাজেট ২০২৫–২৬ এমন কৌশল তুলে ধরবে যা ঋণ ব্যবস্থাপনা, রাজস্ব বৃদ্ধি ও কর সংস্কারের দিকে নজর দেবে।

প্রকল্প বিলম্ব, অনুৎপাদনশীল বিনিয়োগের অভাব, বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবিরতা—সব মিলিয়ে বাজেটে এসব বিষয়ে পরিকল্পিত কৌশল দেখা প্রয়োজন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *