বাংলাদেশে উগ্রবাদী সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর উত্থান ও পতন ঘটেছিল অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে। ২০০৫ সালে দেশের বিভিন্নস্থানে একযোগে বোমা হামলা চালিয়ে সংগঠনটি নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়। তবে শীর্ষ দুই নেতা—শায়খ আব্দুর রহমান ও বাংলা ভাইয়ের গ্রেপ্তার এবং ২০০৭ সালের ২৯ মার্চ ফাঁসি কার্যকরের পর সংগঠনটি কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
শায়খ আব্দুর রহমানের মৃত্যুর পর তার পরিবার দীর্ঘদিন ধরে লোকচক্ষুর আড়ালে রয়েছে। জামালপুর সদর উপজেলার তিতপল্লা ইউনিয়নের চরশী খলীফাপাড়া গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়। এরপর থেকেই তার স্ত্রী আয়েশা রহমান রূপা, স্থানীয়ভাবে পরিচিত নূরজাহান বেগম নামে, সন্তানদের নিয়ে এক প্রকার নিভৃত জীবন যাপন করছেন।
পরিবারের নতুন পথচলা
শায়খ রহমানের পাঁচ সন্তান। জানা গেছে, কেউই পিতার মত চরমপন্থার পথে পা বাড়াননি। বড় কন্যা আফিফা (তোয়া মনি) গৃহিণী। তৃতীয় সন্তান মাহমুদ রহমান (আরশাদ) বায়োকেমিস্ট্রিতে পড়াশোনা শেষে বর্তমানে ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সায়েন্টিফিক অফিসার হিসেবে কর্মরত। বড় ছেলে নাবিল, চতুর্থ ফুয়াদ ও ছোট ছেলে আহমেদ এখনও শিক্ষাজীবনে।
একবার বাড়িতে গিয়ে এক ছেলের সঙ্গে দেখা হলে তিনি জানান, “আমার বাবার নাম আব্দুর রহমান। তিনি অনেক আগেই মারা গেছেন।” বাবার মৃত্যুর কারণ জানতে চাইলে বলেন, “আমরা তখন অনেক ছোট ছিলাম। সম্ভবত দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।”
এ বিষয়ে নূরজাহান বেগমের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “আমাদের কোনো সমস্যা নেই। আমরা ভালোই আছি। এসব অনেক পুরোনো কথা।”
রাজনৈতিক সম্পর্ক ও জীবন পুনর্গঠন
শায়খ আব্দুর রহমানের স্ত্রী আওয়ামী লীগ নেতা ও জামালপুর-৩ আসনের সাবেক এমপি মির্জা আজমের বোন। স্বামীর মৃত্যুর পর ভাইয়ের সহযোগিতায় তিনি পুনরায় ঘুরে দাঁড়ান। জামালপুর শহরে পাঁচ শতাংশ জমিতে প্রথমে একতলা, পরে সেখানে তিনতলা ভবন নির্মাণ করেন। ভবনের আটটি ইউনিটের মধ্যে একটিতে বসবাস করেন নূরজাহান ও তার মেয়ে, বাকিগুলো ভাড়া দেওয়া হয়েছে। ভাড়ার পরিমাণ সাত থেকে দশ হাজার টাকা। বাড়ির সামনে দুটি দোকানঘর রয়েছে, তবে সেগুলো এখনও খালি।
এই ভবন নির্মাণে মির্জা আজম তার বোনকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সহায়তা দিয়েছেন বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। বাবার বাড়ির সম্পত্তির অংশ বুঝে পেতে এবং মামলা-মোকদ্দমা থেকে মুক্তি পেতেও তার ভূমিকা ছিল বলে দাবি পরিবারটির ঘনিষ্ঠজনদের।
জেএমবি প্রধানের ফাঁসির পরেও স্ত্রী ও এক সন্তানকে দেশের বিভিন্ন আদালতে ঘুরতে হয়েছে। তবে সময়ের ব্যবধানে তারা সেসব মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। বর্তমানে তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ বা মামলা নেই।
স্থানীয়দের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ সীমিত। এক প্রতিবেশী বলেন, “তারা প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে বের হন না। বাজার বা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনার সময় পর্দার আড়াল থেকেই বের হন। বাইরে যেতে হলে গাড়ি ব্যবহার করেন।
পরিশেষে বলা যায়, শায়খ আব্দুর রহমানের পরিবারের জীবনের এই অধ্যায় বাংলাদেশের ইতিহাসে জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযানের এক গুরুত্বপূর্ণ পরিণতির প্রতিচ্ছবি। অতীতের কালো অধ্যায় পেছনে ফেলে তারা এখন একটি সাধারণ জীবনযাপনের চেষ্টা করছেন। তবে ইতিহাস তাদের গল্পকে চিরকাল মনে রাখবে—জঙ্গিবাদের উত্থান, পতন এবং একটি পরিবারের নিঃশব্দ পুনর্জন্ম।