নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমেই দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হওয়া উচিত—এমন মন্তব্য করেছেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তিনি মনে করেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত।
বুধবার (১৫ মে) ঢাকা সেনানিবাসের সেনা প্রাঙ্গণে আয়োজিত ‘অফিসার্স অ্যাড্রেস’ অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। উপস্থিত ছিলেন ঢাকায় অবস্থানরত বিভিন্ন পর্যায়ের সেনা কর্মকর্তা, অনেকে যুক্ত হন ভার্চ্যুয়ালি। অনুষ্ঠানে জাতীয় নির্বাচন ছাড়াও সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—যেমন মিয়ানমার ইস্যু, করিডর আলোচনা, চট্টগ্রাম বন্দর, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং সাংগঠনিক সংস্কার—উঠে আসে।
নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে স্পষ্ট অবস্থান
জাতীয় নির্বাচন প্রসঙ্গে সেনাপ্রধান বলেন, “আমার অবস্থান আগের মতোই। দেশের ভবিষ্যৎ পথনির্ধারণের অধিকার কেবল একটি নির্বাচিত সরকারেরই রয়েছে। নির্বাচন অবশ্যই নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই হওয়া উচিত। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তা দেশের জন্য ভালো হবে।”
তিনি আরও বলেন, নির্বাচনকালীন সময়ে সেনাবাহিনী সর্বদা নিরপেক্ষ থাকবে এবং দায়িত্ব পালন করবে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে। দেশের সার্বভৌমত্ব ও সংবিধানের প্রতি আনুগত্য বজায় রেখে সেনাবাহিনী কাজ করে যাবে বলেও আশ্বস্ত করেন তিনি।
মিয়ানমারের রাখাইন করিডর নিয়ে সতর্কতা
সম্প্রতি আলোচনায় থাকা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডর স্থাপন নিয়ে সেনাপ্রধান বলেন, “এ ধরনের সিদ্ধান্ত কেবলমাত্র একটি নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমেই আসা উচিত এবং তা হওয়া উচিত একটি বৈধ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। যেকোনো সিদ্ধান্তে জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া কোনো বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত নয়।”
‘মব ভায়োলেন্স’ সহ্য করা হবে না
দেশের চলমান উচ্ছৃঙ্খলতা ও সংঘবদ্ধ সহিংসতা নিয়ে কঠোর অবস্থান জানান সেনাপ্রধান। তিনি বলেন, “মব ভায়োলেন্স আর সহ্য করা হবে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী আরও কঠোর হচ্ছে। কারা এর পেছনে আছে, তা চিহ্নিত করা হবে এবং যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যবস্থাপনা: স্থানীয় মতামতের প্রয়োজন
চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ার বিষয়েও মন্তব্য করেন সেনাপ্রধান। তিনি বলেন, “এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে স্থানীয় জনগণ এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের মতামত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমেই এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত।”
সংস্কার বিষয়ে সেনাবাহিনীকে অবহিত করা হয়নি
সাংগঠনিক সংস্কার নিয়ে এক প্রশ্নে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, “কী ধরনের সংস্কার হচ্ছে বা কীভাবে হচ্ছে, তা আমার জানা নেই। এ বিষয়ে আমার সঙ্গে কোনো ধরনের পরামর্শ করা হয়নি।”
ঈদে নিরাপত্তা নিশ্চিতে সেনাবাহিনীর সহযোগিতা
আসন্ন ঈদুল আজহা উপলক্ষে মানুষের নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে উৎসব উদযাপনের বিষয়ে সেনাবাহিনীকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন সেনাপ্রধান।
তিনি বলেন, “মানুষ যেন নিরাপদে ঈদ উদযাপন করতে পারে, সেজন্য সকল স্তরে সর্বোচ্চ সহযোগিতা দিতে হবে।”
নিরপেক্ষতা ও আন্তরিকতা বজায় রাখার নির্দেশ
বক্তব্যের শেষাংশে সেনাপ্রধান বলেন, “বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কখনোই এমন কোনো কর্মকাণ্ডে জড়াবে না, যা দেশের সার্বভৌমত্ব বা সংবিধান পরিপন্থী। আমরা নিরপেক্ষ থাকব এবং আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের দায়িত্ব পালন করব।”
তিনি আরও জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনী ইতিমধ্যেই ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে এবং ভবিষ্যতেও সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।
এই বক্তব্যকে ঘিরে সামরিক ও রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচন ও জাতীয় স্বার্থ–সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সেনাপ্রধানের এই সতর্ক ও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।