হুতিদের সঙ্গে যুদ্ধে কেন পিছু হটল আমেরিকা
WhatsApp
WhatsApp Channel
Join Now
Telegram Telegram Channel Join Now

বিশাল সামরিক ব্যয়ের পরও ব্যর্থতা, চুক্তি নিয়ে হতাশ ইসরায়েল, আত্মবিশ্বাসে হুতিরা

২০২৫ সালের বসন্তে লোহিত সাগরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের মধ্যে শুরু হয় এক উত্তপ্ত সামরিক সংঘাত। আন্তর্জাতিক জলপথে হুতিদের ক্রমবর্ধমান হামলা ঠেকাতে ট্রাম্প প্রশাসন শুরু করে ‘অপারেশন রাফ রাইডার’ নামের একটি বড় আকারের সামরিক অভিযান। এক বিলিয়ন ডলারের এই অভিযানের পরিণতি—দুই মাসের মাথায় চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি এবং হুতিদের সঙ্গে কার্যত সমঝোতা। কিন্তু কেন এত দ্রুত পিছু হটল যুক্তরাষ্ট্র? বিশ্লেষকেরা বলছেন, এটি ছিল আমেরিকার একটি কৌশলগত পরাজয়।


সামরিক ব্যর্থতার পর দ্রুত যুদ্ধবিরতির ঘোষণা

২০২৫ সালের মার্চে শুরু হওয়া এই সামরিক অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল হুতিদের ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন ও সামরিক অবকাঠামো ধ্বংস করা। কিন্তু অভিযান শুরুর দুই মাসের মাথায় ৬ মে হঠাৎ করে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দেন, যুক্তরাষ্ট্র ইয়েমেনে বিমান হামলা বন্ধ করবে—শর্ত হলো হুতিরা যেন মার্কিন ও আন্তর্জাতিক জাহাজে হামলা বন্ধ করে।

চুক্তিটি ওমানের মধ্যস্থতায় হলেও এতে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েল সম্পূর্ণ উপেক্ষিত ছিল। এর ফলে চুক্তিকে ঘিরে শুরু হয় তীব্র সমালোচনা। একে বলা হচ্ছে “যুদ্ধের মাঠে পরাজয়ের স্বীকৃতি।”


হুতিদের প্রতিরোধ: আধুনিক প্রযুক্তির চেয়ে ভূগর্ভস্থ ঘাঁটি কার্যকর

হুতিদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৮০০টি স্থানে হামলা চালালেও লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়। হুতিদের ভূগর্ভস্থ সামরিক ঘাঁটি, ডিকেন্দ্রিক কাঠামো এবং ইরানের কৌশলগত সহায়তার কারণে তারা শুধু টিকেই থাকেনি, বরং প্রতিরোধ আরও জোরালো করেছে।

একপর্যায়ে হুতিরা একাধিক মার্কিন যুদ্ধজাহাজকে হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের সামুদ্রিক আধিপত্যের ওপর বড় এক চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেয়।


কৌশলগত ভুল এবং সমন্বয়ের ঘাটতি

এই অভিযানের একটি বড় দুর্বলতা ছিল এর অতিরিক্ত সামরিক নির্ভরতা। লোহিত সাগরের সংকট শুধু সামরিক নয়, বরং এটি গভীরভাবে আঞ্চলিক রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে জড়িত। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে পরিপূর্ণ সমন্বয়ের অভাব, স্থানীয় রাজনৈতিক জটিলতা এবং হুতিদের জনগণভিত্তিক প্রতিরোধ যুদ্ধ—এসব কিছুই যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলকে দুর্বল করে দেয়।

এছাড়া সামরিক পরিকল্পনার একটি অংশ ভুলবশত ‘সিগন্যাল’ অ্যাপে ফাঁস হয়ে যায়, যা প্রশাসনের মধ্যে থাকা সমন্বয়হীনতাকে স্পষ্ট করে।


যুদ্ধবিরতির চুক্তি: কার জয়, কার পরাজয়?

ট্রাম্প প্রশাসন যুদ্ধবিরতিকে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত পুনর্বিন্যাস হিসেবে চিত্রিত করলেও বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। হুতি নেতা আবদুল-মালিক আল-হুতি একে ‘যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয়’ আখ্যা দিয়ে দাবি করেন, “এই চুক্তি আমাদের বিজয় এবং প্রতিরোধের শক্তি”।

এদিকে, ইসরায়েল সম্পূর্ণ অবগত না থাকা অবস্থায় এই চুক্তি ঘোষণাকে দেখছে একটি আস্থার সংকট হিসেবে। হুতিদের হামলায় তেল আবিবের বেন গুরিয়ন বিমানবন্দর ক্ষতিগ্রস্ত হলে ইসরায়েল পাল্টা হামলা চালায় ইয়েমেনের হোদেইদা বন্দর ও সানা বিমানবন্দরে। এতে মার্কিন-ইসরায়েল কূটনৈতিক সম্পর্কে অস্বস্তি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।


“আত্মা বিক্রির চুক্তি” বলছে দ্য ইকোনমিস্ট

The Economist এই চুক্তিকে “A Deal of Surrender” বা আত্মসমর্পণের চুক্তি বলে উল্লেখ করেছে। তাদের বিশ্লেষণে বলা হয়, এর মধ্য দিয়ে হুতিদের নিয়ন্ত্রণ আরও দৃঢ় হবে এবং যুক্তরাষ্ট্র তার মধ্যপ্রাচ্য কৌশলে একটি বড় ধাক্কা খেয়েছে।


উপসংহার: একটি কৌশলগত বিপর্যয়ের পাঠ

হুতিদের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের সামরিক পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে একটি কৌশলগত ভুলের ক্লাসিক উদাহরণ হয়ে থাকবে। এতে যুক্তরাষ্ট্র শুধু বিপুল ব্যয়ই করেনি, বরং তার ‍আন্তর্জাতিক বিশ্বাসযোগ্যতাও খুইয়েছে।

একদিকে হুতিরা হয়েছে আরও আত্মবিশ্বাসী, অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের অংশীদারদের সঙ্গে দূরত্বও বেড়েছে। সামরিক সমাধানের উপর অতির্ভরতা, আঞ্চলিক সমন্বয়ের ঘাটতি এবং ভুল কৌশল—এই তিনটি বিষয়ের সম্মিলিত প্রতিফলনই আজকের এই পরিণতি।


বিশ্লেষকেরা বলছেন, যদি এই পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি রোধ করতে হয়, তবে ওয়াশিংটনকে কেবল বিমান হামলা নয়—রাজনৈতিক বাস্তবতা, আঞ্চলিক ঐক্য এবং দীর্ঘমেয়াদি কূটনৈতিক সমাধানের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *